পরিশুদ্ধতার সূর্যোদয়ে আলোকিত করে তুলি নতুন বছর -রাশেদুল ইসলাম

নতুন ভোরের বার্তা
সকাল মানেই নতুন কিছু। নতুন ভাবনা নতুন করে ভাবা। বর্ষপঞ্জির পাতা খসে গিয়ে নতুন বছর সেরকমই শুভ্রতার ছটায় নতুনত্বের হাতছানি দিচ্ছে। একটি বছরের সবগুলো দিন পেরিয়ে আরো একটি বছরে পদার্পণের যে নিয়ামত মহান আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। বিগত বছরের সময় ও কর্মের মূল্যায়ন করলে একটি বিষয়ই সামনে আসে; সামনে সুযোগ পেলে শুদ্ধ জীবনাচার নিশ্চিত করবো! সেই সুযোগের স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে আমরা কেউ অকৃত্রিম অথবা কৃত্রিম উপায়ে চেষ্টা করে থাকি। কৃত্রিম সবসময়ই কুৎসিত; অপরের কাছেও, এমনকি নিজের কাছেও। কৃত্রিমতার খোলস থেকে বেরুনোর প্রধানতম উপায় হলো নির্ভেজাল অন্তর। মজার ব্যাপার হলো- নির্ভেজাল অন্তর নিয়ে প্রতিনিয়ত পথচলা মহান আল্লাহর ফিতরাত। আল্লাহ সবসময়ই আমাদেরকে খুলুসিয়াতের দিকে ধাবিত করতে চান। বান্দা যখন নতুন করে খালেস জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আল্লাহর প্রক্রিয়ার সাথে বান্দার কর্মের সম্মিলন ঘটে। এ সম্মিলন অকৃত্রিম জীবনায়নের নতুন ভোর। দুনিয়ার সাময়িক সময়ের চাকচিক্যময় উপায় উপকরণের আবরণ সরিয়ে প্রতিটি ভোর যেমন মহান রবের নির্ধারিত নিয়মে শুভ্রতা ছড়ায়। আসলে তা অন্তর সফেদ করার নতুন ভোরের বার্তা। আমাদের দায়িত্ব শুধু সেই বার্তা ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া।

খুলুসিয়াত তথা পরিশুদ্ধতা প্রচার করার বিষয় নয়
অন্তরের খুলুসিয়াত অন্তরের ব্যাপার, এই বিষয়টি আমরা জানি। তারপরেও আত্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করি আমরা। কেউ ভালো কাজের প্রচার করে মানুষকে উৎসাহ প্রদান করার নিমিত্তে এমনটা করে থাকি, আবার কেউ বেখেয়ালে। বাস্তবে তা জনসম্মুখে আসে আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হিসেবে। আমরা যারা ঈমান চর্চা করি, তাঁরাও আজ এই বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়েছি। এমনকি এই বৃত্তের ভিতর থেকে বের হওয়া জরুরি জেনেও বের হওয়ার জোর চেষ্টা করছি না। শয়তান যে এই পরিস্থিতি দেখার জন্যই অপেক্ষায় আছে, তা জেনেও আমরা সতর্ক হই না। বস্তুত খালেস নিয়তে জীবন পরিচালনা থেকে একবার বাইরে বের হয়ে গেলে শয়তান পরবর্তী পদক্ষেপ ভালোর দিকে ফেলতে দিতে চায় না।

প্রচার, প্রদর্শন অতঃপর প্রদর্শনেচ্ছা! এই তিনটি শব্দ পর পর সাজিয়ে বাক্য গঠন করাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। অথচ জীবন পরিচালনার বাঁকে বাঁকে আজ আমরা এই বাক্যটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছি। সামগ্রিক বিবেচনায় উদ্যোগ নেওয়া কাজগুলো পাশ কাটিয়ে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে প্রচার, প্রদর্শন নিয়ে আলোচনা করলে বিশেষভাবে দু’টি বিষয় সামনে এসে যায়।
এক. ছবি/ভিডিও প্রচার : নিজ অবয়বের ছবি তুলে প্রচার আমরা অহরহই করে থাকি। এর নতুন মাত্রা হচ্ছে ভিডিও ধারণ করে তার প্রচার। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো গঠনমূলক বিষয় শেয়ার করার চাইতে যেন এগুলোই বেশি জরুরি। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রামের পাতাগুলো স্ক্রল করলে খুব বেশি অপ্রয়োজনীয় উপকরণ বা বিষয়ের শেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলাফল হিসেবে আমাদের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে যাদের গঠনমূলক কিছু কাজে নিয়োজিত হওয়ার জরুরিয়ত আছে, তারাও এসব কন্টেন্ট দেখে দেখে সময় পার করছেন।

দুই. নিজস্ব কোনো কর্মের প্রচার : গঠনমূলক এবং অযথা উভয় ধরনের বিষয়ের প্রচার আমরা দেখতে পাই। তবে গঠনমূলক বিষয়ের প্রচার খুব কম দেখা যায়। আবার গঠনমূলক কাজ করার ক্ষেত্রে অন্যের আইডিয়া ধার করে কাজ করা বর্তমানে বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে অযথা কাজের প্রচারে মুখর থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তরুণ-যুবকরা।
এসকল প্রচার প্রচারণা যে অন্তরের খালেস ভাব নষ্ট করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না। বিশেষ করে আমাদের জীবনকে কৃত্রিমতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। জাগতিক উপায় উপকরণ হাসিলের মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে প্রচার প্রচারণা। বিশেষ করে গর্ব অহঙ্কারের বিষ অন্তরে ঢুকে যাচ্ছে। অন্তরে গর্ব অহঙ্কার ঢুকলে খুলুসিয়াত নষ্ট হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং তখন খালুসিয়াত-ও প্রচার করে দেখাতে হয়।
পরিশুদ্ধ জীবনের অন্তরায়সমূহ
পরিশুদ্ধ জীবনের আগ্রহ যেহেতু ফিতরাতগত। সেহেতু আল্লাহর বান্দারা স্বভাবতই পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে পজিটিভিটি নিশ্চিত করেন। তবে শয়তানের তৎপরতা মানুষের চিন্তাধারাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিশেষ করে এমন কিছু কাজের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে, যা দৃষ্টিশক্তিকে ঘোলা করে দেয়। তেমনই কিছু বিষয় আমাদের চলার পথের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়। কেউ তা উপেক্ষা করতে পারেন, কেউ পারেন না।

এক. অহেতুক কথা ও কাজ। একজন মুমিনের গুণাবলি-বিরোধী চরিত্র হচ্ছে অহেতুক ও অনর্থক কথা ও কাজ। সূরা মুমিনুনের তৃতীয় আয়াতের মূল মর্মানুযায়ী সকল প্রকার অযথা, অযৌক্তিক, অবাস্তব কাজ থেকে দূরে থাকা মুমিন-সত্তার লক্ষণ।
দুই. জাগতিক চিন্তায় মশগুল থাকা। পৃথিবীর চাকচিক্যময়তা মানুষকে আকৃষ্ট করবে, এটা কুরআনে মহান আল্লাহর ঘোষণা। তা থেকে বেঁচে থাকতেও আল্লাহ পথ ও পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তারপরেও যারা বস্তুবাদী সভ্যতার বিষয়কেই জীবনের মূল চিন্তাধারা এবং কর্মপরিধির নিয়ামক ভাবেন, তাদের অন্তর ¯্রষ্টামুখী হবে না, এটাই স্বাভাবিক।
তিন. মিথ্যা এবং ক্ষতিকর চিন্তা ও কর্মের সাথে লিপ্ত হওয়া। বিশেষ করে হিংসা-বিদ্বেষ, গিবত মানুষকে মিথ্যা এবং অপরের জন্য অকল্যাণকর ও ক্ষতিকর জীবনের দিকে নিয়ে যায়।
খুলুসিয়াত তথা পরিশুদ্ধতা আসবে যেভাবে
অন্তরে খুলুসিয়াত আনার প্রক্রিয়া খুব সহজ এবং সাবলীল। একজন ব্যক্তি অন্তরের খুলুসিয়াত আনয়নের লক্ষ্যে নি¤েœাক্ত উপায় উপকরণ অবশ্যই বেছে নিতে হবে এবং তা সাবলীল ও ধারাবাহিকভাবে।
এক. মহান আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে আস্থাশীল অবস্থান। আয়াতুল কুরসি আমরা মুসলিমরা অধিকাংশই মুখস্থ রাখি। তবে এর মর্মার্থ আমরা ক’জন অনুভব করি। এখানে খুব সুন্দর করে মহান আল্লাহ তাঁর অস্তিত্বের জানান দিয়েছেন এবং দুনিয়ার সকল প্যারামিটার দিয়ে পরিমাপ করলে কিংবা বিবেচনা করলেও মহান আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহাতীত থাকতে বাধ্য হবে। এজন্য আবারো বলছি, মহান আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী হতে হবে সবার আগে।

দুই. অন্তকরণে মহান আল্লাহর ইউনিক সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সন্দেহাতীতভাবে বদ্ধমূল হতে হবে। মহান আল্লাহর সাথে দুনিয়ার কোনো সত্তার সার্বভৌমত্বের তুলনা চলে না। এবং তাবৎ সার্বভৌমত্বের ফেরিওয়ালাদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব সবকিছুই মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে; এর উপর আস্থাশীল থাকা। সূরা ইখলাসে মহান আল্লাহর ঘোষণা তাই প্রমাণ করে।
তিন. মহান আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন এবং তাঁর প্রতি সচেতনতা ও ভয় লালন করা। এক্ষেত্রে অনুভব করতে হবে যে, আল্লাহ সার্বক্ষণিক আমাদের অন্তরের আগ্রহ-অনাগ্রহ, পদক্ষেপ এবং চিন্তাক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তারিত খবর রাখেন।
চার. নিজ কর্মপরিধি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা। মানুষের জীবনের প্রতিটি অতিবাহিত মুহূর্ত পরবর্তী সময়ের জন্য কল্যাণ অথবা অকল্যাণ বয়ে আনে। বিশেষ করে অন্তরের স্বস্তির জন্য নিজ কাজের ক্ষেত্র এবং কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি।

পাঁচ. সততার উপর টিকে থাকা। ইমাম গাজালির মতে- কথা, নিয়ত, সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ তথা কর্ম সম্পাদনে সততা নিশ্চিত করতে পারলেই কেবলমাত্র মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সিদ্দিক মর্যাদায় ভূষিত হওয়া যাবে।
আন্তরিক প্রচেষ্টায় পরিশুদ্ধতা আসবে
সর্বপ্রথম ব্যক্তির ব্যাকুলপ্রাণা অস্তিত্ব আল্লাহমুখিতার নজির হওয়া বাঞ্ছনীয়। নামাজ আদায়ের জন্য মনোযোগ যেমন বেশি জরুরি। তেমনি অন্তরে খালেস পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইলে উদ্যোগী হতে হবে উদ্যমী মানসিকতায়। দুনিয়ার গতিপ্রকৃতি নিয়ে ভাবাতুর হয়ে সময় অতিবাহিত করার বিপরীতে সকল পরিস্থিতি, শয়তানের ওয়াসওয়াসা, দৈন্যতা, প্রতিবন্ধকতা পাশে রেখে দৃপ্তপদে নতুন করে এগোতে হবে। লক্ষ্য যখন ভোর, তখন আঁধার থামাতে পারে না। কবির ভাষায় বলতে গেলে-
‘ছিঁড়ে যাক পাল ভেঙে যাক হাল আসুক তমসা ঘোর
সপ্তসিন্ধু পাড়ি দিয়ে তবু আনতেই হবে ভোর।’
লেখক : সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ

মন্তব্য