ইতিহাস ও প্রকৃতির সাথে ৮ দিন

  • আবরণ এত পাতলা যে, ভেতরের আলু দেখা যাচ্ছে অস্বচ্ছ ভাবে।
  • ভিতরে আলু মাত্র তিন টুকরো।
  • ভিতরের ফাঁকা জায়গা অনেকটা তেলে পরিপূর্ণ।
  • স্বাদ খারাপ না, আলাদা এক ধরনের, যা ইতোপূর্বে অন্তত আমি কখনো পাইনি।  

বিষয় এখানেই শেষ নয়! হাসতে হাসতে আমার অবস্থা কাহিল হল তখন, যখন আলিম বলল- “এই ছেলে ৮০ টাকায় ১০০ টা সিঙ্গাড়া দিবি?” আমার হাসির সাথে যোগ দিল আশেপাশের অনেকেই। আলিম আসলেই একটা খাদক। তবে আমারও খেতে অর্থাৎ আলিমের ইচ্ছায় একমত হতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মত দিতে পারলাম না। কারণ বেশি তেলে ভাজা খাবার, জানিনা কি পরিবেশে বানিয়েছে। খেলে অসুখ করতে পারে।

রাত ৮.১৬

১৯.০১.২০১১

 

রাত ৮.১৬ তে কলম ছেড়েছিলাম। তাই মন চাইছিল ঠিক সকাল ৮.১৬ তে কলম ধরব। কিন্তু মনের ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব হলো না। এখন সময় সকাল ৭.৩৪।

ভ্রমণের ৪র্থ দিন দ্বিতীয়বারের মত লিখা শুরু করলাম। মাঝের দুই দিন কোন ভাবেই সুন্দর মনোবাসনা নিয়ে বসার ফুসরত ছিল না। ট্রেনে বসে লেখার আনন্দটাই অন্যরকম। তবে ঝাকুনি ও দুলুনির সাথে সাথে কলমও অল্প অল্প দুলতে থাকে। গত ক’দিনের সবগুলো মজার ঘটনা মনে নেই। কিছু ভাসা ভাসা কথাই লেখার চেষ্টা করব।

২০০৫-২০০৭ অনেক দীর্ঘ সময়। অথচ ঢাকায় থাকা এ দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই দেখা হয়নি সুন্দর-দর্শণীয়-অকর্ষণীয় দেখার জায়গাগুলির। মাত্র দু’দিনে আর কতইবা দেখা যায়।
 


২০.০১.২০১১ ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। 

সকাল ৯.৩২ তে ঢুকলাম ঢাকা চিড়িয়াখানায়। সঙ্গে অতিরিক্ত একজন অতিথি ছিল আমাদের সাথে। তিনি আমাদের সাথে যোগ হন মিরপুরে। মিরপুরে শুরু, মিরপুরেই সমাপ্ত হল তার সঙ্গ। তিনি হলেন খুলনার শওকত ভাই। প্রথম রাত তার কাছেই কাটাই আমরা।

মাত্র ১ ঘন্টা ২০ মিনিটে পূর্ণাঙ্গ দর্শনার্থী হিসেবে আমরাই হয়তো প্রথম দর্শন করলাম আমাদের প্রিয় ঢাকা চিড়িয়াখানা। সোয়েটার খুলতে হয়েছে ৩০মি: পরই। তারপরও ঘেমে গিয়েছিলাম তখন।

প্রাণীকূল পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে, একথা Population Resource and Environmen কোর্সে পড়লাম মাত্র ক’দিন আগে। আর তার সাথে একটু সংযোজন করতেই হচ্ছে যে, প্রণীকূল মানুষের মানসিক ভারসাম্যও রক্ষা করে। একে একে বিভিন্ন প্রজাতির বানর, তার সাথে বানরের হাস্যকর কাণ্ড কারখানা দেখে আসলেই অনেক আনন্দ পাই আমরা। যেসব প্রাণী দেখলাম তার সবগুলোর বর্ণনা লিখতে গেলে অনেক বড় একটা ফিচার হয়ে যাবে। ছোটবেলা দাদুদের কাছে শোনা সেই গল্পের বাঘের হালুম শব্দ অনেক কাছ থেকে শুনে সত্যিই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সরু একটা দেয়ালের উপর দিয়ে বাঘটা এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে আর আমাদের দিকে তাকিয়ে শব্দ করছে, সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। জলহস্তি দেখে হাসি পেল আমাদের। দেহের তুলনায় চোখ, কান এতটাই ছোট যে, দেখে অস্বস্তি লাগল আমার। আর লেজের অবস্থাতো আরও করুণ। জলহস্তি দেখে হাসি পেলেও স্রষ্টা তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে এর দ্বারা অনেক কিছু বুঝিয়েছেন। তার একটি হলো সুন্দর অসুন্দরের মিলন স্থল এই পৃথিবী। সবকিছু সুন্দর থাকলে ভালো লাগতো না, একঘেয়ে হয়ে যেত।

 

চিড়িয়াখানায় আমাদের সবচেয়ে উপভোগ্য ব্যাপারটি ছিল ময়ূরের পেখম মেলা। আমরা এটা আশাও করিনি। অথচ খাঁচার সামনে আসা মাত্রই ময়ূরটি তার শরীরের তুলনায় বিশাল পেখম মেলে ধরল আমাদের সামনে। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ মহিমার যে কোন শেষ নেই তা ময়ূর দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।    

 

জীবনে এত ছবি তুলিনি কখনও। কখনও ছবি তোলাটা আনন্দের ব্যাপার হয়নি। ব্যক্তিগত কোন এ্যালবামও নেই আমার। তবে বন্ধুদের সাথে যেসব ছবি তোলা হল, তা খুব একটা খারাপ হয়নি।

এরপর আমরা ঢুকলাম জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। কৃত্রিমতা মেশানো এ বাগানের মূল রাস্তাটা আমাদের মত যেকোন ভ্রমণকারীর নজর কাড়বে। দুপাশের সাজানো গাছগুলোর মাথার দিকে তাকালে মনে হয় রাস্তাটা যেন কুয়াশা দিয়ে ঢাকা। এখানে ছোট ছোট ফলকে কিছু বাণী লেখা আছে যা অনেক মূল্যবান। একটা বাণী আমার নজর কেড়েছে তা হলো- “প্রকৃতি হচ্ছে চলমান পাঠাগার”। খুব অল্প সময়ে আমরা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান দেখা শেষ করি।

 

গ্রুপ ভ্রমণের মজাটা বুঝলাম এবার। বিপত্তিটা দুপুর গড়াতেই শুরু হল। আসলে দীর্ঘ সময় ধরে কেডস্ পরে কখনও থাকা হয়নি, যার দরুণ কষ্টটা কখনও বুঝিনি। অন্য সমস্যাটা হচ্ছে পায়ের তুলনায় এবারকার কেনা কেডস্ জোড়া একটু আঁটসাট। তাই পায়ের অনেক অংশে লেগে একেবারে ব্যাথা হয়ে গেছে। পরে খুব ভাল লাগল, যখন চুপিসারে নভোথিয়েটারের অন্ধকার শো রুমে বসে কেডস্ খুলে সেন্ডেল পরলাম। সবাই তা দেখে কিছুটা হাসাহাসি করেছিল।

 

কখনো কখনো মেয়েমানুষের সাথে খাপ খাওয়ানোটাই দায় হয়ে পড়ে। ভ্রমণের শুরুতে কিছু নিয়মাবলী সংযোজন করা দরকার ছিল। যেমন, অতিরিক্ত কোন ফ্রেন্ডস নামক ভেজালের সাথে সাক্ষাৎ চলবে না বা আরও অনেক কিছু। জনি! মমিনের এক্স-ক্লাশমেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানী বিভাগের ছাত্র। ছেলেটা অমায়িক। এতটা অল্প সময়ে সে আমদের সাথে মিশে গিয়েছিল, যা ভাবতেই অবাক লাগে। ধন্যবাদ জনি’কে। সমস্যা অন্য জায়গায়! প্রথম দেখাটাই হয় তার সাথে থাকা অন্য একটা মেয়েসহ। ঝামেলা করে ঐ মেয়েটাই। আমাদের হাতে সময় খুব কম ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা দেখে চন্দ্রিমা উদ্যান ও সংসদ ভবন দেখার সিডিউল ছিল। কিন্তু বাণিজ্যমেলায় এতটা সময় চলে যায় যে, পরবর্তী দুই তালিকা ব্রেক করে নভোথিয়েটার দেখতে যাই আমরা। মেয়েটা আমাদের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে কেনাকাটা করতে থাকে, যা আমদের জন্য অনেক পীড়াদায়ক হয়। আশা করছি পরবর্তী কোন ভ্রমণে আমরা যেন এই বোকামিটা কেউ না করি। ধন্যবাদ মেয়েটাকে, তার এই অনাকাঙ্খিত সাক্ষাতের জন্য। আর কাউকে সে এরকম কষ্ট না দিক এটাই আমাদের কামনা।

 

এবার নিয়ে পাঁচবার দেখলাম নভোথিয়েটারের শো। প্রথম তিনবার ছিলো ভাসানী নভোথিয়েটার, তারপর থেকে হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার। একমাত্র বাংলাদেশেই এটা সম্ভব। কোন এক নাট্য পরিচালকের ভাষায় বললে বলতে হয়- সম্ভব অসম্ভবের দেশ, বাংলাদেশ। 

 

প্রাকৃতিক উপমায় সাজানো বাংলাদেশের সৌন্দর্য্য দেখেই যেখানে আমরা মুগ্ধ, সেখানে সারা পৃথিবীর কথা ভাবলে বুকটা এক ইঞ্চি ফুলে উঠে, সেই সাথে চোখও। অথচ এখানেই শেষ নয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিলীলা। আমাদের এই পৃথিবী পরিমণ্ডলের বাইরের গ্রহরাজি, তাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে সৌরজগৎ। এরকম বহু সৌরজগত সমেত মহাবিশ্বের কথা চিন্তা করলে বুকটা দুরু দুরু করে। না উপভোগ করলে কাউকে বোঝানো যাবে না। তাই নভোথিয়েটার বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। স্রষ্টার ভাষায়Ñ তোমরা জমিনে পরিভ্রমণ কর এবং আমার সৃষ্টির তত্ত্ব অনুসন্ধান কর, কারণ এতে জ্ঞানীদের জন্য ভাবনার খোরাক রয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বের জ্ঞানার্জনের সংকল্পে দৃঢ় হয়ে আমরা বের হয়েছিলাম নভোথিয়েটার দেখে।

 

বসুন্ধরা সিটিতে নাস্তা সেরে দ্বিতীয় দিনের মত ভ্রমণ শেষ করলাম। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা রাত্রি যাপন করি। রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের রুকন ভাই চা খাওয়ান শীর্ণ এক চা স্টলে। দারুচিনি আর দুধের সাথে কড়া লিকারের এক কাপ চায়ের কথা মনে থাকবে আজীবন।

 

২১.০১.২০১১ ভ্রমণের তৃতীয় দিন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দেখে আমরা চলে যাই লালবাগ কেল্লায়। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র প্রিন্স মোহাম্মদ আযম ১৬৭৮ সালে এটি তৈরি করেন। প্রাচীন শাসকদের এই স্থাপনা আমাদের মুগ্ধ করে। এদেশে আধুনিকায়নের রূপরেখার গোড়াপত্তন হয়েছিল লালবাগ কেল্লা থেকেই। স্থাপনাগুলোর কারুকার্য এতই নিখুত যে বর্তমান স্থাপত্যকারদেরও সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। 

সেখান থেকে আমরা যাই আহসান মঞ্জিলের উদ্দেশে। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক আমলের নিদর্শন আহসান মঞ্জিল। ফরিদপুরের জমিদার এনায়েত উল্লাহ কর্তৃক নির্মিত উজ্জ্বল লাল গোলাপী রঙের এই অট্টালিকা আমাদেরকে দূর থেকে দেখতে হয়েছে। কারণ সেদিন এর প্রবেশদার উন্মুক্ত ছিলো না।

 

আলিমকে আমরা সবাই সবসময় ক্ষ্যাপাই। আসলে এতটা ক্ষ্যাপানো ঠিক না। হয়তো সে কষ্ট পেতে পারে। তবে নিছক মজা করাই এর উদ্দেশ্য। ঢাকায় আমাদের সাথে সম্পূর্ণ নতুন হচ্ছে একমাত্র আলিম। সে এ ভ্রমণে অত্যন্ত আনন্দিত, সেজন্য অতিরিক্ত কিছু আনন্দ হচ্ছে আমাদের সকলের।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু যাত্রা বিরতি দিয়ে আমরা চলে যাই সতের শতকে নির্মিত বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ দেখতে। দুপুরের পর দেখি ফ্রেমে বাঁধানো ইতিহাসের আরেক নিদর্শন জাতীয় জাদুঘর। অতীত-বর্তমানের এক নীরব সেতুবন্ধন এই জাদুঘর। জাদুঘর দেখতে দেখেতে সময় এতটাই পেরিয়ে যায় যে, সিডিউলে থাকা স্মৃতিসৌধ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারলাম না আমরা। কারণ ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

 

তৃতীয় দিনের ভ্রমণ সমাপ্ত করলাম খিলক্ষেত গিয়ে। ঢাকার বন্ধু শামীমের কাছে রাত কাটাই আমরা। আসলে থাকার কথা ছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শামীমের এখানে রাতে বসে আমার পায়ের ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। কেডস্ পরা ছেড়ে দিয়েছি তৃতীয় দিন সকালে। তাই এখন কিছুটা আরাম বোধ করছি। 

 

 

২২.০১.২০১১ ভ্রমণের চতুর্থ দিন। 

শুরুতেই আনন্দ ভ্রমণ। ঢাকা-কুলাউড়া দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা। যান্ত্রিকতার মোড়কে গোছানো রাজধানীর অসহ্য কোলাহল ছেড়ে আমরা ছুটে চলেছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আরেক অপরূপ ক্ষেত্র মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। ট্রেনটা চলছিলো ভালোই। বিপত্তিটা কিছুদূর যেতেই হলো। পুবাইল স্টেশনে এসেই ট্রেনের ইঞ্জিন ফল করে। সকাল ৮.১৫ থেকে ১০.০০ পর্যন্ত অসহ্য অপেক্ষা। তবে মজা করেই কাটিয়েছি সময়টা। আমাদের ঝপযবফঁষবফ অতিথি হাবীবের জন্য আনন্দের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে এখন। 

ট্রেন চলছে সাঁ-সাঁ করে। কত খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, গ্রাম-শহর যে পেরুলাম তার কোন হিসেব নেই। ট্রেনে ঘুমটা খুব সুন্দর হয় অনেকের। আলিম পালন করছে সেই নিয়ম। আমার ঘুম আসে না সহজে। 

আজ চতুর্থ দিন চলছে। প্রতিজ্ঞা নয়, ইচ্ছে ছিলো সাত দিন পর গোসল করবো। দেখা যাক কতদূর এগুনো যায়। এ মতে একমত আমরা দু’জন। তবে আলিম আজ সকালে মাথায় শ্যাম্পু নিয়েছে। তার ইচ্ছায় কিছুটা ফাটল ধরেছে। আমি আছি এখনও অটল।

 

ভ্রমণটা শীতের শেষ দিকে হলেও অতিরিক্ত শীত বস্ত্র নিয়ে ব্যাগ ভারী করেছিলাম সবাই, যা অনেক কষ্টদায়ক। ব্যাগটা সাথেই রাখতে হচ্ছে সারাক্ষণ। কারণ কোন ভাবেই পেছন ফেরার অবকাশ ছিলো না আমাদের। কাঁধের ব্যাথায় চার সদস্যই কাতর। তার পরও চলছি ঠিক মতই।

 

এ পথ পরিক্রমা সুন্দর হোক, এই কামনা করছি আর ট্রেনের শব্দ শুনছি। আর দেখছি ট্রেনের দুপাশ দিয়ে পিছিয়ে পড়া স্রষ্টার অপরূপ মহিমায় সমৃদ্ধ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী পর্বত সমূহ। 

সকাল ১১.১৩

২২.০১.২০১১

 

সেদিনের পর আজ আবার কলম চালু হলো। আমাদের গ্রুপ ভ্রমণ শেষ হয়েছে কথামত ২৬ জানুয়ারি ২০১১-তে। এখন শুধুই স্মৃতি। মন থেকে হয়ত সেসব স্মৃতিও মুছে যাবে। তারপরও হাতড়ানোর চেষ্টা করছি। দেখি কিছু অম্লান স্মৃতি রাখা যায় কি না পটে।

নৌকা কখনও পানি ছাড়া চলে না। কিন্তু পানি নৌকায় প্রবেশ করলে সেটা দ্রুত সেঁচের ব্যবস্থা করতে হয়। এটাই বাস্তবতা। তদ্রুপ পৃথিবী ছাড়া মানুষ চলতে পারবে না। কিন্তু পৃথিবী যদি মানুষের মাঝে ঢুকে যায় তবে কেমন হবে সেই মানুষের মূল প্রকৃতি অথবা অভ্যন্তরীণ আকৃতি? মূল প্রকৃতি বা অভ্যন্তরীণ আকৃতি যেমনই হোক না কেন তবুও পথ চলতে হবে আমাদের।

নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। তাই অনেক কিছুই জানা-বুঝা-শেখা হয়নি। দেখাও হয়নি অনেক কিছু। তাই যেখানেই যাই সেখান থেকেই জানতে চাই, যেন বুঝে কিছু শেখা যায়।

 

দুপুরের খাবার খেতে অনেক বিলম্ব হয়েছিল সেদিন। বিকাল ৪.১৫-তে আমরা ঢুকলাম একটা রেস্টুরেন্টে। খেয়েছিলাম সামান্য, মুরগী, সবজি আর ডাল। কিন্তু অয়োজন একেবারেই ভিন্ন। ছোট্ট একটা কড়াইয়ে করে গরম মুরগীর মাংস রান্না করে এনে রেখেছিল হোটেল বয়।

তারপর দীর্ঘ অটোরিক্সা জার্নি। উদ্দেশ্য মাধবকুণ্ড। ড্রাইভার বলল দূরত্ব ৫০ কি.মি.। কিন্তু আমার মনে হলো কমপক্ষে ৭০ কি.মি. পথ অতিক্রম করেছিলাম। পৌঁছে দেখি সন্ধ্যা নেমে গেছে। তার উপর পাহাড়-পর্বত ঘেরা এলাকা। সন্ধ্যার পূর্বেই অন্ধকার। সাথে শীত। কি আর করা টিকিট কেটেই দৌঁড় সবার। অন্যদিকে সমস্যা তো আছেই। পায়ের যন্ত্রণায় হাটতে পারছি না। কারণ আবারও কেডস্ পরেছি। অবস্থা বেগতিক, কোন ভাবেই দৌঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ দৌঁড়াতেই হবে। অন্যরা ২০০ মিটার সামনে চলে গেছে। তবে আশা জাগলো পেছন ফিরে। মমিনেরও একই সমস্যা। আমাদের দুজনের মতামত হলো, এত তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, প্রয়োজনে পরের দিন আবার আসব। কিন্তু সেকি আর সম্ভব?

 

শীতের কাঁপুনি, পায়ের ব্যাথা, সময়ের স্বল্পতা সবকিছু মিলিয়ে শেষ হলো আমাদের মাধবকুণ্ড দর্শন।

বহু ফটোগ্রাফী, ওয়ালপেপার, টিভি-লাইভসহ অনেক ভাবে দেখা হয়েছে জলপ্রপাত। স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম। হাবীব-মমিন-আলিম তো বায়না ধরলো, গোসল করবে ঝরনার পানিতে। কিন্তু অনুমতি দেয়া গেল না। একেতো হিম-শীতল পানি তার উপর শীত সন্ধ্যা।

 

কথা ছিল মাথাটা নুয়ে পড়বে। হলো উল্টো। মাথা উঠে গেল আকাশের দিকে, চোখ ভরে উঠল জলে। হে মহান সৃষ্টিকর্তা! তুমি আসলেই অনেক সুন্দর। তাই তোমার সৃষ্টিও এত সুন্দর। ২০০ মি. উপর থেকে পড়ছে পানির অবিরাম ধারা। চলছে এ ধারা নিরন্তর।

সময়ের স্বল্পতা হেতু বিদায় নিতে হলো। ক্যামেরায় ফ্লাশ লাইট না থাকায় আধো-আলোয় কিছু ছবি তুলেই আমরা ফিরলাম সর্বোচ্চ স্মৃতির মাধবকুণ্ড থেকে। দীর্ঘ সময় নিয়ে কবে আবার যাব স্রষ্টার সেই অপার নিদর্শন দেখতে, সেটাই ভাবছি এই ক্ষণে, প্রতি ক্ষণে।

 

কুলাউড়া থেকে মাধবকুণ্ড যাওয়ার পথে হাকালুকি হাওড় দেখলাম দূর থেকে। অতিথি পাখির মিলনমেলা হয় এখানে। গাড়ীর শব্দের কারণে পাখিদের মিষ্টি কলরব শোনা হলো না।

 

পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ-অসহ্য কিছু লোক যদি থেকে থাকে তার মধ্যে ইমরান ভাই প্রথম সারির একজন। এ লোকটাকে আগেও সহ্য হতো না। এখনও হচ্ছে না। বিরক্তির একশেষ তার প্রতিটি কাজ।

বর্ণনা-

ইমরান আহমেদ। উচ্চ মাধ্যমিক একসাথে পড়েছি। সিলেটের কানাইঘাটে তার বাড়ী। বিশেষত্বÑ হাফেজে কোরআন।

প্রথমেই শুরু করল অটোরিক্সার ভাড়াটা পরিশোধ করে দিয়ে। পরপর একই কাণ্ড করার চেষ্টায়রত। ক্ষমা চেয়ে পা ধরার জোগাড় হল আমাদের। তারপরও সে এই কাজ থেকে বিরত থাকল না।

সেদিন রাত কাটিয়েছি তার বাড়ীতে। খেতে গিয়ে তো দেখি আরেক অস্থির অবস্থা। সারা টেবিল জুড়ে বাটি আর বাটি। কোনটা খালি নেই। মাছ-মুরগী-গরুর মাংস। প্রত্যেকটার একাধিক প্রকার। মনে হলো লোকটাকে ধরে কিছুক্ষণ পেটাই। কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। বিনা বাক্য ব্যয়ে সহ্য করলাম তার এই অত্যাচার। সিলেটে আরও একবার এসেছিলাম আমি। তখনও তিনি এরকম করেছিলেন। ভাবছি আর কোনদিন সিলেটে যাব না। কারণ আমাদের বাড়ীতে নিয়ে গেলেও কোনদিন এত খাতির-আপ্যায়ন করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। যা তিনি করলেন।

সকালে শুরু হলো আরেক ধামাকা। একটার পর একটা। একবার ঝাল তো একবার মিষ্টি। সেমাই এলো তো নুডলস তারপর আবার মিষ্টি। এক প্রকারের নির্যাতন বৈকি।

সুরমা নদীর পাড় ঘেষে ইমরান ভাইদের বাড়ী। সেই সুবাদে নদী তীরে ঘুরলাম সকালটা। অনেক ছবি তুললাম আমরা। নদীর তীরে সকালবেলা বেড়ানোর মজাই আলাদা। দু:খজনক কথা হলো, সুরমা নদী থেকে গ্যাসের বুদ্ বুদ্ উঠতে দেখলাম স্বচক্ষে। অথচ গ্যাসের অভাবে সারাদেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে।

এবার ফিরব। তখন আরেক অত্যাচার। রাতের সেই মেন্যু, শুধু পোলাও বাদে। পালনকর্তার কাছে দোয়া করছি। জীবনে যেন তিনি আমাকে আর তার বাড়ীতে না নেন।

 


২৩ জানুয়ারি ২০১১। শুরু হলো আমাদের পঞ্চম দিনের ভ্রমণ। 

সিএনজি অটোরিক্সায় করে এক দীর্ঘ জার্নি। মনে হলো এত জার্নি জীবনে এই প্রথম। যেন কোন এক মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছি। সাকসেসফুল না হলে বড় কোন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাবো। আরেকবার যখন সিলেটে এসেছিলাম তখনও ইমরান ভাই একই কাজ করেছিলেন। শহরের কোন জায়গা দেখাতে বাকী রাখেননি তিনি। এসেছিলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। প্রথম দিনেই ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম তার সাথে সিলেট শহর দর্শন অভিযানে।

 

যাক-

প্রথমে গেলাম টিপাইমুখ। এলাকাটার নাম আমনসিধ। নদীর নাম বরাক। তার থেকে দুটি শাখা, সুরমা-কুশিয়ারা। ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশের সীমানার টিপাইমুখে এসে এই দুই নদীর জন্ম দেয়। কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যমণ্ডিত মোহনাটি মরে যাবে। মরে যাবে সুরমা-কুশিয়ারা।

ভারত আমাদের সাথে বরাবর বৈরী আচরণ করে যাচ্ছে। তাই মোহনাটির অদূর উজানে একটি বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করেছে সে দেশের সরকার। পরিণামে গোটা সিলেট অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। দু:খ নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।

 

এরপর একটানে গেলাম বাংলাদেশের সর্বপূবের সীমান্তবর্তী থানা জকিগঞ্জে। সীমান্তের ওপারে ভারতের করিমগঞ্জ জেলা। কুশিয়ারা নদী দ্বারাই তৈরী এই সীমান্ত।

আরেক নিদর্শন দেখলাম জকিগঞ্জ থেকে ৪০ কি.মি. পশ্চিম-উত্তরে, ফুলতলী পীরের বাড়ী। কথিত আছে এই ৪০ কি.মি. পথের ডান পার্শ্বের সমস্ত জমির মালিকানা ফুলতলী পীরের বংশধরদের। তবে আশার বাণী হলো, সেখানে জ্ঞান বিতরণও হচ্ছে। একটা মাদ্রাসা আর এতিমখানা আছে এখানে। আর সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরীও আছে। 

সেখান থেকে গেলাম কানাইঘাট শহরে। বিদায় নিলাম ইমরান ভাইয়ের নিকট থেকে। এবার আমাদের সাথে রইলেন ইমরান ভাইয়ের ভাগ্নে আ. মুহিত (মামা)।

 

 

লেগুনাতে করে পৌঁছলাম জাফলং। 

মাগরিবের দু’ঘন্টা আগে আমরা সেখানে পৌঁছাই। সিলেট শহরের প্রায় ৫৫ কি.মি. উত্তরে সিলেট-শিলং (ভারত) যাতায়াতের পথের প্রান্তসীমায় অবস্থিত। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য চমৎকার। মুগ্ধকর পর্বতের দৃশ্য ছাড়াও চা-বাগান দেখা যায়। নৌকায় করে ছোট্ট একটা নদী ধরে জিরো পয়েন্টে পৌঁছাই আমরা। আমাদের একেবারে হাতের নাগালে বিএসএফ-এর ক্যাম্প-ব্যাঙ্কার।

 

প্রকৃতিই মানুষের মনে সান্ত্বনার জন্ম দেয়। মানুষের আকাক্সক্ষা নগরায়নের দিকে হলেও প্রকৃতিকে কখনও ভুলে যেতে চায় না কেউ। তাইতো মানুষকে ছুটে আসতে দেখা যায় প্রকৃতিপানে।

ভারতের একটা জলপ্রপাত থেকে আসা পানিতে সৃষ্ট নদীর সেই নির্মল শীতল পানি ছুয়ে শিহরিত হলো কেউ কেউ। সেখানে অনেক সময় কাটাই। অনেক ছবি তুলি।
 

 

দুই পাহাড়ের সংযোগ একটি ঝুলন্ত সেতুর মাধ্যমে। তা দেখলাম আমাদের সীমান্তের ওপারে অর্থাৎ ভারতে। পাথর তোলার দৃশ্য দেখে মায়া হচ্ছে। কত কষ্ট করে শ্রমিকরা পাথর তুলছে, অথচ এই পাথরে নির্মিত অট্টালিকায় যারা বসবাস করছে তাদের স্বস্তি কত নিবিড়। সৃষ্টিকর্তার এ কি লীলা-খেলা।

সময় থাকলে সেখানে গোছল করা যেত। কিন্তু সন্ধ্যে নামার কারণে ফিরতে হলো। কেনাকাটা সারলো অনেকেই। 

 

অবশেষে ফিরলাম সিলেটে।

রাতের খাবার সেরে নিলাম সিলেট শহরের ভাই ভাই রেস্টুরেন্টে। এখানে ভাতের জন্য আলাদা করে কোন টাকা নেয়া হয় না। চিংড়ি ভর্তা, চিংড়ির বড়া, ডাল আর কোয়েলের মাংস খেলাম। কোয়েলের মাংস একটু মিষ্টি জাতীয় হয়, তাই সাথে ডিম ও সস্ দিয়ে থাকে। আলীম তো ডিম দেখে রেগে গিয়েছিল। সবাই তাতে হাসাহাসি করেছিল।

 

এখানকার রেওয়াজ অনুযায়ী চা ও পান খেলাম। সিলেটের চা আসলেই অপূর্ব হয়। বিয়ানীবাজারের এক ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টে প্রথম চা খাই। চা টা খুব স্বাদের ছিলো।

 

জাফলং থেকে ফিরেই প্রথমে যাই হযরত শাহ পরান (র.)-এর মাজারে। কথিত বারো আউলিয়ার একজন হযরত শাহ্ পরান (র.)। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী ধর্মপ্রচারক। একাধারে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। তার মাজারে কত ধরণের শিরক যে হচ্ছে তা নিজে চোখে দেখলাম। এক লোক অগ্নি পূজা করছে। ভাগ্যিস দিনের বেলা যাইনি, তাহলে যে কত কিছু দেখতে হতো।

 

রাতেই হযরত শাহজালাল (র.)- এর মাজারে যাই। ১২ টাকায় পানি কিনে দু’জনে টয়লেট সেরেছিলাম শাহজালাল (র.) এর মাজারে। সমাজের হাল হকিকত এখন এমনই। ব্যবসার আরেক উজ্জ্বল নিদর্শন এই মাজার।

 

সিলেটের অলি-গলিতে মাজার অবস্থিত। তাই আমাদের জামান হাসতে হাসতে বলেছিল আমার মৃত্যুটা যেন সিলেটে হয়। আর মৃত্যুর পর বন্ধুরা যেন শেখ জামান (র.) বা শাহ জামান (র.) নামে মাজার খুলে বসে। সেটা শুনে হাসলাম সবাই।

 

নিরব রাতের সিলেট শহর মুহিত মামার সাথে সাইকেলে করে ঘুরলাম। অনেক সুন্দর লেগেছিলো। ঐতিহ্যবাহী ক্বীন ব্রিজ সাইকেলে অতিক্রম করেছিলাম। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজেও গিয়েছিলাম সেদিন রাতে। আরও কত কি যে দেখলাম তার নাই ঠিক ঠিকানা।

রাত কাটানোর কথা ছিলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে অনেক রাত হয়ে যায়। শহর থেকে অনেক দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান হওয়ায় রাতে আর যাওয়া হয়নি। মুহিত মামার বাসাতেই রাত কাটাই।

 

পরদিন সকাল অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি ২০১১। ভ্রমণের ষষ্ঠ দিন। 

প্রথমে যাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুপ্রতিম প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন হলেও প্রযুক্তিতে সবার উর্ধ্বে অবস্থান করছে। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার মত। পর্বত বিধৌত এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের সিলেট ভ্রমণ। যাত্রা করি শেরপুরের উদ্দ্যেশ্যে ময়মনসিংহে।

রাত ৪.৫২

০৩.০২.২০১১

 

মিডিয়ার কল্যাণে আমরা বর্তমানে বিশ্বের তথা দেশের সকল প্রান্তের সব ধরনের খবরাদি আমরা পেয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সেসব খবর শুনে আমরা অনেক আবেগ তাড়িত হয়ে উঠি। তবে বাস্তবতা অন্যরকম। বন্যায় রাস্তা ভেঙে যায় এটা সবাই জানি। তাই বলে মাইলের পর মাইল রাস্তা একাধারে ভাঙা ভাঙা থাকবে ভাবতে অবাক লাগবে অনেকের। কিন্তু এটাই সত্য।

সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ভৈরব থেকে যে রাস্তাটি ডান দিকে চলে গেছে সেটি ধরেই চলছে আমাদের বাস। বড় বড় পরোটা আর মুগ ডাল সহকারে সকালের নাস্তা, চা আর মস্ত বড় সাইজের পানের খিলি মুখে পুরে বাসে উঠেছিলাম সকাল ১০.০০ টায়। ঘন্টা দেড়েক ভালই চলল গাড়ীটা। অতপর শুরু হলো ড্রাইভারের প্রিয় কারসাজি। ব্রেক কষাটাই যেন তার মূল কাজ হয়ে দাড়ালো। আমাদের (যাত্রীদের) ভাগ্য ভালো যে রাস্তায় মোট তিনবার যাত্রা বিরতি দিয়েছিলো। কিশোরগঞ্জ এলাকাটা অনেক সমৃদ্ধ জানতাম। কিন্তু একাধারে অবহেলিত, একথাটা জানা ছিলো না।

ছোট বেলায় জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কৌটার ভিতর জাম, লবণ, মরিচ ঢুকিয়ে দু'হাতে করে অবিরাম ঝাকিয়ে জাম ভর্তা করার অভিজ্ঞতা আমার মত অনেকেরই থাকবে হয়তো। ভর্তা করা জামের যে অবস্থা হয় আমাদের (যাত্রীদের) অবস্থা কিছুটা সে রকমই হয়েছিলো সেদিন। বাসের সিটগুলো আরামদায়ক ছিলো তাই রক্ষে। ময়মনসিংহে পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭.০০ টা বেজে গিয়েছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে সারাদিনের এই বাস ভ্রমণ সম্পন্ন হয়েছিলো মাত্র ২২০ টাকার বিনিময়ে (প্রতি জন)।

খানিক বিরতি দিয়ে আবার বাসে উঠি আমরা। ময়মনসিংহ থেকে শেরপুর পৌঁছতে সময় অল্পই লেগেছে। শেরপুর শহর থেকে আমাদের বাড়ীর দূরত্ব ৬ কি.মি.। রাত ১১.০০ টায় আমরা বাড়ীর আঙিনায় ঢুকি। বড় আপা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। দীর্ঘ দিন পর বাড়ীতে গেলাম, তার ওপর বন্ধুদের সাথে নিয়ে। অন্যরকম আনন্দ লাগছিলো আমার।

 

ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটি গুণ নেই বললেই চলে। তা হলো অতি দ্রুত অচেনা কারও সাথে ভাব জমানো। আমাদের জামানের এই গুণটি উল্লেখ করার মত। মজার ব্যাপার হলো বন্ধুরা সবাই আমাদের ফ্যামিলির সবার সাথে অতি দ্রুত আপন পরিবারের সদস্যদের মত হয়ে যায়।

 

আমার বাবা। এই ব্যক্তিকে আমি ভালোবাসি না। কারণ ভালোবাসার যেসব সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত জানা হয়েছে, তার চেয়েও গভীরতর কোন উপলব্ধি আমার মনে উঁকি দেয় উনার প্রতি। তাই বাবাকে ভালোবাসি বললে আমার কাছে মনে হয় তাকে ছোট করা হচ্ছে। সাধারণত দিনে বেশি ব্যস্ত থাকেন বলে তিনি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। সেই রাত্রে শীতের প্রকটতা খুব বেশি ছিলো। তারপরও তিনি জেগে ছিলেন। কুশলাদি বিনিময় ও রাতের খাবার শেষে তিনি আমাদের সাথে অনেকক্ষণ আলাপ চারিতায় মেতে ছিলেন। সত্যিই আমি আমার বাবার জন্য গর্বিত।

 

মা। সে তো এক মহা সমস্যা। আমরা মাত্র দু’রাত্রি ছিলাম আমাদের বাড়ীতে। এত অল্প সময় থাকায় সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছেন তিনি। চলে আসার সময় আমার সাথে ভালো ভাবে কথাও বলেননি। কারণ উনার ইচ্ছে ছিলো কয়েকদিন থাকবো আমরা, পিঠা-পায়েস রান্না করবেন, নারকেল-চিড়া তৈরী করে খাওয়াবেন। সারা জীবন ছেলে মেয়েদের জন্য চিন্তা ভাবনা আর সাংসারিক কাজ করতে গিয়ে নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করেননি। তাই বয়স অনেক বেশি না হলেও শরীরিকভাবে অনেক ভেঙে পরেছেন তিনি।

 

একটানা দীর্ঘ জার্নির কারণে আমাদের কারোরই খাবারের রুচি ছিলো না। এমনকি আলিম এবং আমারও না। তাই আমাদের বাড়ীতে প্রত্যেকবার খেতে গিয়ে অনীহার সম্মুখীন হয়েছি। এতে বেশি কষ্ট পেয়েছেন ভাবী আর ছোট আপা। যেন ফাঁকি দিতে না পারি এজন্য ভাবী আমাদের সাথে খেতে বসেছেন পর্যন্ত।

 

নতুন আত্মীয়-অতিথি পেলে আমার বড় ভাই গল্পে মেতে ওঠেন। আমার দাদার কাছ থেকে তিনি এই স্বভাবটা পেয়েছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে আমার বড় দুই ভাই বেশি সময় দিতে পারেননি। আমরা চলে আসায় বড় ভাই খুব রাগ করেছেন।

 

আমার দুই দুলাভাই আমাকে অনেক ভালোবাসেন। ছোট দুলাভাই জরুরী কাজে ঢাকায় ছিলেন। আর বড় দুলাভাই শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও দেখা করতে এসেছিলেন তখন, যখন মধুটিলা-গজনী বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাই দেখা হয়নি তার সাথে।

 

ইচ্ছামত শেরপুরে আমাদের বাড়ীতে এসে গোসল করলাম। সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে গোসল করার মজাটাই অন্যরকম। গত সাত দিন পর গোসল করায় শরীরটা ফুরফুরে লাগছিলো।

 

 

২৫ জানুয়ারী ২০১১। ভ্রমণের সপ্তম দিন। 

মাত্র দু’টো জায়গায় গিয়েছি এদিন। মধুটিলা ইকোপার্ক এবং গজনী অবকাশ। সিলেটের যেসব জায়গায় গিয়েছি তার অধিকাংশ জুড়েই ছিলো পাহাড়। তবে সরাসরি পাহাড় দেখার উদ্দেশ্যে শেরপুরের এই দুই স্পটে গেলাম। 

 

১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধুটিলা ইকোপার্ক পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমাদের বাড়ী থেকে মাত্র ১৯ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মোড়ানো এই পর্যটন কেন্দ্রে এবারই প্রথম গেলাম। আসলে প্রকৃতি দেখার জন্য যে প্রকৃতির মন মানসিকতা থাকা দরকার, তা এতদিন আমার মাঝে তৈরী হয়নি। তাই অনেক সুযোগ আসা সত্ত্বেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। 

সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ওঠার ব্যবস্থাটা অনেক সুন্দর লেগেছে। সর্বোচ্চ পাহাড় থেকে  নিচের  দিকে যখন তাকালাম, সবুজের সমারোহ দেখে মনে হলো যেন সবুজের এক চাদর বিছিয়ে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। এখানকার গোটা পর্যটন এলাকার ঠিক মাঝ বরাবর একটা পর্যটন টাওয়ার অছে। যেখান থেকে সমস্ত পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। 

 

আমাদের এদিনকার ভ্রমণে আনন্দের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিলো দু’টো কারণে। 

এক. মুক্ত বাতাসকে ছুঁতে ছুঁতে মোটর বাইকে করে যাওয়ার কারণে। 

দুই. নতুন একজন ভ্রমণ সঙ্গী সাথে পেয়ে।

 

লুৎফর চাচা। আমাদের নতুন ভ্রমণ সঙ্গী। চির তারুণ্যে ভরা এক ব্যক্তি। নতুন কোন ছেলেদের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের সাথে মেতে উঠার যে প্রবণতা আমি দেখলাম, তা সত্যি আনন্দদায়ক। তিনটি মোটর সাইকেলে করে আমরা ছ’জন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে অনেক মজা করে ঘুরলাম। পাহাড়ের বুক চিরে তৈরী করা হয়েছে আঁকাবাঁকা লেক। অতপর লেক পারাপারের জন্য সুন্দর একটা ব্রিজ, যার মধ্য বরাবর গোলাকার ফাঁকা জায়গা, যেখানটার নিচে লেকের পানি দেখা যাচ্ছে। সত্যিই অপূর্ব।

পাহাড়-জঙ্গলে দস্যু থাকে এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর যখন গিয়েছি তখন পুরো পর্যটন এলাকায় সুনসান নিরবতা। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি গভীর অরণ্যে না গিয়েই ফিরলাম মধুটিলা থেকে।

 

এরপর ছোট ভাবীর নবজাতককে দেখার উদ্দেশ্যে গজনী অবকাশ যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতি করি আমরা। অত:পর অনিচ্ছা ও ক্ষুধামন্দা থাকা সত্ত্বেও খেতে হলো অনেক আইটেমের খাবার। ছোট্ট বাবুর একটা নামের (সাদিক জাফরুল্লাহ) প্রস্তাবনা রাখলাম সবাই মিলে। খানিক বিশ্রাম শেষে রওনা দিলাম গজনী অবকাশের দিকে।

 

পাহাড়ের কোল ঘেঁসে আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ মাড়িয়ে তীরবেগে ছুটছি। সারি সারি গজারি গাছ আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে অনবরত। উঁচু থেকে নিচের দিকে নামতে গিয়ে গাড়ীর চলমান গতিতে যেটুকু অতিরিক্ত গতি যোগ হচ্ছে তা দিয়ে আবার উঁচুতে উঠছি, আবার নামছি। মনে হচ্ছিলো এ পথ যদি না শেষ হতো! সূর্যের তেজোদ্দীপ্ত শিখা যখন নি®প্রাণ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন গাড়ী থামালাম একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কিনারে।

 

যখন পৌঁছুলাম তখন অনেক ভ্রমণকারীরা বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিক সেদিক কিছুক্ষণ ঘুরে গাড়ী রেখে পেডেল বোটে করে লেক ভ্রমণে যোগ দিলাম। লেকের সাথে পাহাড়ের সম্পর্ক সত্যিই সুনিবিড়। পানি-পাহাড়-বোটের সাথে খেলা করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। সূর্য ততক্ষণে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। তারপর ছুটলাম পাহাড়ের ভেতর। পিচঢালা রাস্তা যতদূর চলল, আমাদের গাড়ীও চালালাম ততদূর। মায়া-চিত্রা হরিণ, পাহাড়ী হাতি, পদ্ম সিঁড়ি, উঁচু উঁচু পাহাড়, রাবার বাগান। কিছুই দেখা হলো না সময়ের অভাবে। এমনকি পর্যটন টাওয়ারে পর্যন্ত ওঠা হলো না।

 

অত:পর ফেরা। রাস্তায় আরেক বিড়ম্বনা। গাড়ীর যে স্ক্রু’টা তেল নিয়ন্ত্রণ করে সেটা বেশি টাইট দেয়া ছিলো, তাই আমি যে গাড়ী চালাচ্ছিলাম সেটার তেল শেষ। পাহাড়ের মাঝামাঝি অবস্থানে আছি। নাই দোকান-পাট, নাই জনবসতি। কি আর করা। অন্য গাড়ীতে করে ৩ কি.মি. পেছনে ফিরে কিনে আনা হলো তেল। জীবনী শক্তি পেয়ে গাড়ী আবার চলা শুরু করল। বাড়ী পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।

 

রাতে গানের আড্ডা হলো অনেক্ষণ। জামান, হাবীব ও আমার একমাত্র ভাগ্নি মারিয়ার গান চললো একের পর এক। ভাগ্নে রিফাতও গাওয়ার চেষ্টা করলো। পরিবারের সবার সরব উপস্থিতিতে সমাপ্ত হলো আসর। রাতের খাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি।

 

২৬ জানুয়ারী ২০১১। দেখতে দেখতে সাত দিন পেরিয়ে অষ্টম দিনে পা রাখি। 

আমাদের ফ্যামিলির সবাই ভেবেছিলো আরো দু-চার দিন থাকবো। কিন্তু থাকা হলো না। কথা মতো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার জন্য ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনার প্রস্তুতি নিই।

 

বাড়ীর সবাই কিছুটা বিরক্ত। বিশেষ করে ভাতিজা-ভাগ্নে-ভাগ্নিরা তো বটেই। কিন্তু যেতে তো হবেই। তাছাড়া ক্লাশ পরীক্ষা তো আর বাদ দিলে চলবে না।

 

বাসটা ময়মনসিংহ পৌঁছতে অনেক বিলম্ব করেছিলো। এদিকে সেদিনই আমাদের রাজশাহী ফেরার কথা। যার দরুণ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটা তো নয়ই শুধু চোখের সামনে যেটুকু পড়েছে সেটুকুও ঘুরে দেখা সম্ভব হলো না। কারণ ৩.০০ টায় বাস, এর মধ্যে নামাজ, খাওয়া তো আছেই।

 

মমিন ও আলিমকে রাজশাহীর বাসের টিকিট রিজার্ভ করার জন্য রেখে আমি, জামান এবং হাবীব ছুটলাম ঢাকার বাস কাউন্টারের দিকে। পথিমধ্যে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে দেখলাম। যদিও কষ্ট হচ্ছিলো, তারপরও বিদায় দিতে হলো হাবীবকে। এমনিতেই তার দু’দিন ক্লাস মিস্ ও একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা মিস্ হয়েছে। আসলে হঠাৎ করে আয়োজিত এ ভ্রমণে আনন্দ এতটা পরিমানে হবে এটা ভাবতে পারিনি। তাই মায়াটাও পরস্পরের  প্রতি অনেক বেড়ে গেছে এই ক’দিনে।

 

মায়া-মমতার কথা ভবতে ভাবতে আর রাহমানুর রাহীম মহান আল্লাহ পাককে ধন্যবাদ দিতে দিতে আমরাও গাড়ীতে উঠলাম। চললাম রাজশাহীর দিকে।

 

তারপর! 

তারপর আবার সেই যান্ত্রিক জীবন। সেই চিরচেনা রুটিন। ক্লাসে যাওয়া, খাওয়া, পড়াশোনা, ঘুমানো। কোন ব্যতিক্রম ঘটানো যাবে না। এভাবেই চলছি। চলবোও হয়তো এভাবেই।

বিকাল ৪.৫১

২২.০৫.২০১১

মন্তব্য