অসঙ্গতির মোহনায় অধঃপতনের বেদনা

একটি কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে যাবেন হয়তো। তবু বলছি- ‘মুসলিমদের অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে- কুরআন থেকে নিজেদের দূরে রাখা’। আপনি হয়তো বলবেন, ‘এটা চিরন্তন সত্য কথা’। আপনার সাথে একমত না হওয়ার যুক্তি আমার কাছে নেই। কারণ, আরবের জাহেলরা কুরআনের সংস্পর্শে এসেই নিজেদের সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন। এমনকি, সাহাবায়ে আজমাঈনদের সেই বীরত্বগাথা আমাদের গায়ে কাঁটা দেয় আজো। আর তাইতো সাহাবা জীবনের আলোকে নিজেকে গঠনের টার্গেট মুসলিম মাত্রেরই হয়ে থাকে শৈশব থেকে। কিন্তু শৈশবের সে আকাঙ্ক্ষা ম্রিয়মাণ হয়ে যায় অনেকের; বয়স বাড়ার সাথে সাথে। তখন আপনি সেই ব্যক্তি বিশেষদের কাছে বলতে শুনবেন- ‘বাস্তবতা বড় কঠিন’!
আমার আজকের আলোচনা এখানেই। কঠিন বাস্তবতা নিয়ে আমরা কতটুকু পেরেশান?
আমরা খেয়াল করলে দেখবো- জীবন চলার স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটার সাথে সাথে আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পরমুহূর্তে তা কাটিয়ে উঠার জন্য কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে দিই আমরা। আর ভুলগুলোর রিপিটেশন আটকে দিই। যার ফলে সুন্দর সময়ের আগমন ঘটে পরবর্তীতে।

সমাজজীবনেও অনুরূপ দেখবো আমরা। সমাজের প্রতিটি বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি সকাল শুরুর সাথে সাথে আশা করেন যে, আমাদের সমাজের পরিবেশ গতদিনের চেয়ে সুন্দর হবে আজ। এ আশার বাস্তব দিকগুলো আরো সুন্দর। প্রতিটি মুসলিম বাড়ির সকাল ঐশী গ্রন্থের সুমধুর ধ্বনিতে সুর মেলাচ্ছে প্রকৃতির সাথে; যেখানে সকল প্রাণিকুল আল্লাহর নামে গান গেয়ে দিনের শুরু করছে। টার্গেট, দিনান্তে স্রষ্টার অখুশির কাজগুলো শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা।
কিন্তু এই বাস্তবতা আজ কতটুকু বাস্তব আমাদের সমাজ জীবনে?
সমাজটা আজ এমনভাবে সাজানো হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে যে, স্বস্তি শুধু আকাক্সক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ; বাস্তবতা নয়। যেমনটা কাঁঠাল গাছে আম আশা করাটা অবাস্তব। মুসলিম জীবনের সকল কাজ হবার কথা কুরআনের আলোকে। বিপরীত ব্যবস্থা কায়েমের কারণে আমরা তার প্রতিফল দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলা যায়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র যেখানে কুরআনের পরশে বিকশিত এবং প্রচলিত হবার কথা, সেখানে বস্তুবাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠাকারীদের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার নিয়ামক হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। এমনকি আগামী প্রজন্মও সেদিকেই ধাবমান। আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, ইসলামী কৃষ্টি কালচার বিব্রত করে আমাদেরকেই। বরঞ্চ, অনৈসলামিক আবহে চলাফেরা করাটা স্মার্টনেস বিবেচিত হচ্ছে ইদানীং।

দুঃখজনক হচ্ছে, এসব সাংস্কৃতিক আবহ এবং প্রবাহ অনেক ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষীদের উপহাস এবং ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। ‘এপ্রিল ফুল’ তার অন্যতম। মুসলমানদের দুঃখের ইতিহাস দিয়েই আজ মুসলমানরা আনন্দ উদযাপন করছে। কী এই এপ্রিল ফুল, তা জানার কোনো আগ্রহই নেই আজ সমাজে!
আরবের জাহেলিয়াত আমাদের সকলেরই জানা। সাধারণ মানুষের জীবন ছিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের খেলার সামগ্রী। সব ধরনের অপকর্ম সাধারণ বিষয় ছিলো তখন। ঠিক সেই সময়ে আল্লাহর শেষ বার্তাবাহক মুহাম্মদ সা. অন্ধকার দূর করার একমাত্র মশাল কুরআন নিয়ে সমাজ পরিচালনা করেন। যাকে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অন্ধকার যুগ বললেও তা ইতিহাসে স্বর্ণালি যুগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আজো। প্রিয় রাসূলের সেই সোনালি সমাজের ধারা সাহাবাদের হাত ধরে বিস্তৃত হয়েছিলো অর্ধেক বিশ্ব জুড়ে। থেমে থাকেনি এই অগ্রগতি; সময়ের আবর্তে ইসলামের অমিয় ধারা আরবের মরুভূমি জয় করে আজকের ইউরোপের বুকেও স্থায়ী ঠিকানা করে নেয়। মুসলিম বীর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ইউরোপের স্পেনসহ আশপাশের বিশাল এলাকার মানুষকে এ সুমহান আদর্শের বাণী বুঝাতে সক্ষম হন। তারপর সুদীর্ঘ সময় ইসলামের আলোকে সমাজ পরিচালনা হতে থাকে এখানে।

পরিতাপের বিষয় হলো, ইউরোপের রাজ-রাজরাদের মতো বিলাসী জীবনের হাতছানিতে স্পেনের মুসলিম শাসকরাও ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় একসময়। নেতৃত্বের আদর্শ বিচ্যুতির মাধ্যমেই রচিত হয়েছিল লাখো জীবন বিনাশের ইতিহাস। শোকাবহ এপ্রিল সেই ইতিহাসেরই ফল। অথচ বর্তমান সময়ের মুসলমানরা কষ্টের ইতিহাস থেকে আত্মবিস্মৃত হয়ে সেই শোকাবহ দিনটিকে আনন্দের উপলক্ষ করে পালন করছে। নিচে এপ্রিল ফুলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরছি-
ইউরোপের অত্যাচারী শাসক রডারিকের অমানুষিক নির্যাতনে যখন মানুষের জীবন অতিষ্ঠ তখন মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ভূমধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা পাড়ি দিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালীতে উপস্থিত হন ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী প্রথমে আন্দালুস (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) আক্রমণ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ৩০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মুসলিম বাহিনীর সাথে রাজা রডারিকের বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয় এবং রডারিকের বাহিনী পরাজিত হয়ে পালানোর সময় খ্রিষ্টানদের শাসক রডারিক গুলডেল কুইভারে ডুবে মারা যায়। রডারিকের মৃত্যুর মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় নিশ্চিত হয়। মুসলমানরা ইউরোপের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মালাগা, গ্রানাডা, আল হামারা, সেভিজা, তালেদো ও কার্ডোভাসহ বিশাল এ অঞ্চলের খেদমতের জিম্মাদারি পায়। এ বিজয়ের পর সুদীর্ঘ ৮০০ বছর মুসলমানরা ইউরোপের স্পেনসহ বিভিন্ন অঞ্চল সুনামের সাথে শাসন করেন। মুসলমানদের এই শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমরনীতিতে স্পেন বিশ্বের নেতৃত্বে চলে আসে।

ইউরোপে মুসলমানদের এ সোনালি শাসনের ৩২২ বছর পর শুরু হয় অধঃপতন। শাসকদের বিলাসী জীবন, অনৈতিকতা, নারী লিপ্সা তাদেরকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বহুদূরে সরিয়ে দেয়। সুযোগসন্ধানী খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বেশ ধারণ করে, ইসলাম ধর্মের শিক্ষা গ্রহণ করে মসজিদের ইমাম ও খতিব হয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করে। অন্যদিকে মুসলিম শাসকদেরকে নারী এবং অঢেল সম্পদের মাধ্যমে বশীভূত করে ফেলে। তৎকালীন খ্রিষ্টান নেতৃত্বে থাকা রানী ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দের বাহিনী মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার শস্যক্ষেত জ্বালিয়ে দেয় এবং নগর ধ্বংস করে। এক এক করে দখল করতে থাকে সমস্ত এলাকা। এমনকি শহরের প্রধান খাদ্য সরবরাহকেন্দ্র ভেগা উপত্যকাকেও ধ্বংস করে দেয়। এভাবে ইসলামের পরাজয় নিকটবর্তী হয়। স্পেনের সব এলাকার মুসলমানরা চরম খাদ্য ঘাটতির মধ্যে পতিত হয়। এই সুযোগে স্পেনের ভূভুক্ষু মুসলমানদের শক্তিহীনতাকে পুঁজি করে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা এবং তাদের বাহিনী স্পেনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় মুসলমানরা চরম সঙ্কটে পড়ে। ফার্দিনান্দ ঘোষণা করে, ‘যে সকল মুসলমানরা নিরস্ত্র হয়ে গ্রানাডার মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে আর যারা খ্রিষ্টানদের জাহাজগুলোতে আশ্রয় নেবে তাদের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অন্যথায় আমাদের হাতে তোমাদের প্রাণ হারাতে হবে।’

নিরুপায় মুসলমানরা সরলমনে খ্রিষ্টানদের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে গ্রানাডার মসজিদ এবং খ্রিষ্টানদের জাহাজগুলোতে আশ্রয় নেন। সৈন্যরা মসজিদগুলোতে বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে এবং জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় খ্রিষ্টানদের বীভৎস আনন্দ উৎসব। যা আজকের মুসলিম সমাজ হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না! মুসলমানরা যে সকল মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল সে সকল মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং আশ্রয় নেয়া জাহাজগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। সেদিন মুসলিম শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীর মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তচিৎকারে গোটা ইউরোপের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল আর তখন বীভৎস হাসি দিয়ে ইসাবেলা বলেছিল, ‘হায়, এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে?’ ইতিহাসের এ মর্মান্তিক দিনটি ছিল ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল (৮৯৭ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল)। এ ঘটনায় ৭ লাখের অধিক মুসলিমকে হত্যা করেছিল খ্রিষ্টানরা। আর ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনাকে উপলক্ষ করেই বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টানরা প্রতি বছর এপ্রিলের প্রথম দিন ‘এপ্রিল ফুলস ডে’ বা ‘বিশ্ব বোকা দিবস’ পালন করে থাকে।

আমরা মুসলিমরা বোকাই রয়ে গেলাম। আমাদের হত্যার দিনে আমরাই উৎসব করি। আমরা আমাদের সংস্কৃতির সাথে এসব মিশিয়ে ফেলেছি; ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই স্লোগান থেকে। মুসলিম সংস্কৃতিকে ধ্বংসের জন্য ইদানীং ‘মানব ধর্ম’ নামে নতুন এক জগতে প্রবেশ করছি আমরা। এখানে সবাই একসাথে অবাধে চলাফেরা করার দৃষ্টিভঙ্গি চর্চা করা হয়। ধর্ম-বর্ণ-জাতির কোনো সীমানা থাকবে না এই মানব ধর্মে। আসলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইসলাম বিরোধীদের তৎপরতাকে সমর্থন জানিয়ে আমরা কখন এসব ঘৃণ্য কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি তা আমরা বুঝতেই পারছি না।

মন্তব্য