রাসূলের (স.) দেখানো পথ ধরে আবারো সেই সোনালী সমাজ আসবে

 হে মানবম ণ্ড লী,আমি একজন মানুষ। হয়তো খুব দ্রুতই আমার কাছে আল্লাহর আহবায়ক এসে যাবেন এবং তার ডাকে সাড়া দেব। আমি দুটো দায়িত্বের বোঝা তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। তার একটা আল্লাহর কিতাব। এতে রয়েছে সঠিক পথের নির্দেশনা,আলো ও হিকমত। দ্বিতীয় বোঝাটি হলো,আমার পরিবারের লোকেরা। আমার পরিবারের লোকদের সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করার আহ্বান জানাই। 

 
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পথে  গাদীরে খুম  নামক পুকুরের পাশে যাত্রা বিরতির সময় বিশিষ্ট সাথীদের উদ্দেশ্যে রাসূল (স.) উপরোক্ত ভাষণ দেন। নবী রাসূলদের অতিমানব ও অমানব আখ্যায়িত করে যারা নানা ধরণের গোমরাহীর পথ উন্মুক্ত করেছিল, তাদের ভুল দূর করার জন্য তিনি নিজেকে মানুষ বলে আখ্যায়িত করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো- যে নবীগণ শিরকের মূল্যোৎপাটন ও আল্লাহর একত্ববাদ কায়েমের লক্ষ্যে আজীবন লড়াই করেছেন, জীবন দিয়েছেন; অতিউৎসাহী মানুষরা সেই নবীদেরই আল্লাহর সন্তান আখ্যায়িত করে চিরঞ্জীব সত্তা বলে মনে করেছে।
 
উপরের ভাষণে নিজের সাথীদেরকে এই বলে সতর্ক করেন যে, আমি মানুষ। তাই অন্যান্য মানুষের মত আমার ওপরও আল্লাহর আইন চালু হবে। তারপর তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে কোরআন অনুসরণের নির্দেশ দেন এবং এটাকে একটা দায়িত্বের বোঝা বলে অভিহিত করেন। কারণ রসূল (স.)এর নিকটাত্মীয়রা তাঁর জীবনের প্রতক্ষ্যদর্শী এবং তাঁর মূল্যবান শিক্ষাসমূহের আমানতদার। এ দিক থেকে তারা উম্মতের জন্য ইসলামী শিক্ষার উৎস। আর তাদের জন্য তিনি কোন ধন সম্পদ রেখে যাননি এবং তাদের ভবিষ্যতকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে গেছেন। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, রসূল (স.) এর পর তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের ওপর বিরাট দায়িত্ব বর্তে। কিন্তু তীব্র আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তিনি এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট বক্তব্য না দিয়ে ইংগিতে বোঝাতে চেয়েছেন।
 
বিদায় হজ্জ মুসলিম মিল্লাতের জন্য এক সর্বব্যাপী বিপ্লবের নাম। যে বিপ্লব পৃথিবীর পরবর্তী মানবম-লীর জীবন পরিচালনার আলোকবর্তিকা। রাসূলুল্লাহ (স.) বিশ্বব্যাপী দ্বীন প্রতিষ্ঠার সুনিপুন কর্মকৌশল বলে দিয়ে গেছেন তার শেষ ভাষণে।
 
তৎকালীন বি শ্ব পরিস্থিতি
রসূল (স.) যখন নবুয়াতপ্রাপ্ত হন তখন সারা বিশ্বে অগণিত নৈতিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছিল এবং যার সমাধান ছিল অত্যন্ত জরুরী। আমরা সমস্যাগুলোর কিছুমাত্র তালিকা করতে পারি-
 
  • রোম ও পারস্য সা ম্রাজ্যে চরম স্বৈরাচার।
  • বংশীয় ও শ্রেণী বৈষম্যের চরম পর্যায়।
  • দুর্বলের উপর শক্তিমানের অসহনীয় অত্যাচার।
  • বিভিন্ন ধরণের অবৈধ অর্থনৈতিক শোষণ।
  • নিকৃষ্ট ধরণের নৈতিক অনাচার ছড়িয়ে পড়েছিল।
  • বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ,নিরাপত্তাহীনতা, অজ্ঞতা,ক্ষুধা ও দারিদ্র্য।

 

 
এই পরিস্থিতিতে কোন সংস্কারক নেতার কাজ হতো-
 
  • অজ্ঞতা ও নৈতিক অনাচার দূর করা।
  • পারস্পারিক গৃহযুদ্ধ প্রতিহত করা
  • ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূল করা।

 

 
রাজনৈতিক নেতার কাজ হতো-
 
  • দুর্বলের উপর শক্তিমানের অসহনীয় অত্যাচা রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।
  • বিভিন্ন ধরণের অবৈধ অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা।
  • সা ম্রা জ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াই করা।
  • বংশীয় ও শ্রেণী বৈষম্য দূর করার কর্মকৌশল গ্রহণ করা।

 

 
রাসূলের (স.) সংস্কার পদ্ধতি
প্রচলিত ধারার বিশেষ কোন নেতা, হোক সে রাজনৈতিক আথবা সংস্কারক- এসকল কাজ করতে গেলে তার চরিত্র নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতো না এবং সে তার নেতৃত্ব সফলকাম করার জন্য কোন প্রতারণা, কোন ষড়যন্ত্র, ছলচাতুরী, বলপ্রয়োগ এবং গণহত্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে কণামাত্র দ্বিধাবোধ করতো না। তারপর উভয় ধরনের নেতৃত্ব একটি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বই হতো। ফলাফল হিসেবে কায়েম হতো একটি জাতীয়তাবাদী জীবনব্যবস্থা।
 
অপরদিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (স.) একই সাথে সংস্কারক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সময়মতো উপরোল্লেখিত পরিস্থিতি ও সমস্যাদির একটি একটি করে শুধু সমাধানই করেননি, বরঞ্চ এক বিরাট বিপ্লব সংঘটিত করেন তিনি। আর এই কাজকে একটি সুমহান আদর্শরূপে বাস্তবায়িত এবং পরবর্তী যুগের সকল মানুষের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় করে রাখতে একটি বুনিয়াদী সংস্কারের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দেন। আর সেই সংস্কারের বিষয়গুলো হলো-
 
  • লোকেরা যেন আল্লাহর একত্ববাদের উপর ঈমান আনে। অন্য সকল খোদার বন্দেগী ত্যাগ করে এক আল্লাহর বন্দেগী করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর হুকুমকে অবশ্য পালনীয় মনে করে।
  • পথনির্দেশ, শিক্ষা ও আইন-কানুনের (কুরআন) যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এবং এসব কেবলমাত্র রাসূলের (স.) মাধ্যমেই, তা মেনে নেয়া।
  • আখেরাতের উপর বি শ্বাস স্থাপন করবে এবং এটা মনে করে দুনিয়ার কাজ পরিচালনা করবে যে, অবশেষে মৃত্যুর পর খোদার সামনে হাজির হয়ে নিজের সকল কাজের জবাবদিহি করতে হবে।
  • চরিত্রের ভালো ও মন্দ দিকগুলোর ঐসব অপরিবর্তনীয় নীতি অনুসরণ করে চলতে হবে যা আল্লাহ, তাঁর রাসুল (স.) ও তাঁর কিতাব পেশ করেছে।
  • যারা এ আহবানে সাড়া দিবে তারা এমন এক উম্মত হয়ে যাবে যে এ দাওয়াতের সাক্ষ্য হিসাব দাঁড়িয়ে যাবে, দ্বীনকে বিজয় করার জন্য জান ও মালের বিরাট ঝুঁকি নেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হবে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন করার জন্য প্রয়োজনে জাহেলিয়াতের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করবে।

 

 
রাসূলের (স.) এই সংস্কারের গুরুত্ব ও মূলনীতি
প্রথমত: এই সংস্কার হলো দ্বীনে হক প্রতিষ্ঠার জন্য। রাসূলের (স.) আগমনের মূল উদ্দেশ্যই হলো সমগ্র মানবজাতিকে সঠিক বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা।
দ্বিতীয়ত: ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সামগ্রিক জীবনে যতো ভুলের সৃষ্টি হয় তার আসল কারণ নিজেকে স্বাধীন ও দায়িত্বহীন মরে করা। এই অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করা।
 
কাজের জন্য যাদেরকে পাওয়া গেলো
ব্যাপক বাধা উপেক্ষা করে কেবলমাত্র তারাই রাসূলের (স.) দিকে এলো যাদের চিন্তাধারা ছিলো স্বচ্ছ, যারা বাস্তবতা উপলব্ধি করার ও মেনে নেয়ার যোগ্যতা রাখতো, যাদের মধ্যে এতোটা সততার অনুরাগ বিদ্যমান ছিল যে, যখন একটি বিষয় সম্পর্কে তারা জেনে ফেললো যে, তা সত্য- তখন তার জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতে এবং মৃত্যুর সাথে খেলা করতে তারা তৈরী হয়ে গেল। এ আন্দোলনের জন্য এমন সব লোকেরই প্রয়োজন।
 
বর্তমান সময়েও সম্ভব
আন্দোলনের স্বার্থে রাসূল (স.) আপন দেশ, জাতি, গোত্র, পরিবার কারো স্বার্থের কোন পরোয়া করেননি। ঈমান আনয়নকারী পর ছিল তাঁর আপন। ঈমান যারা আনেনি তারাই ছিল তাঁর পর। এ জিনিসই দুনিয়াবাসীর মনে এ দৃঢ় প্রত্যয় দান করে যে, তিনি মানুষ হয়ে মানুষের কল্যাণের জন্যই আবির্ভূত হয়েছেন, আর এ জিনিসই তাঁর দাওয়াতের প্রতিটি দেশ ও জাতিকে আকৃষ্ট করে। প্রকৃতপক্ষে যে বিষয় সকলকে আকৃষ্ট করছিল তা ছিল আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে অবস্থান।
রাসূলের (স.) সমগ্র আন্দোলন আজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন থেকে আন্দোলনের মূলনীতিগুলো এবং যার জন্য এ আন্দোলন তার প্রতিটি বিষয় আজ সুস্পষ্ট। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ এবং তৎপরতা থেকে ইসলামের প্রকৃত প্রাণশক্তি উচ্ছলিত হচ্ছিল এবং মানুষ উপলব্ধি করতো বলেই সফলতা এসেছিলো। আজো যদি আমরা পূর্ণ অনুসরণ করতে থাকি, তবে আবারো সেই সোনালী সমাজ আসবে।

মন্তব্য